প্রতিদিন চরকা

প্রতিদিন চরকা

অমর একুশে ফেব্রুয়ারি"

 

 

অমর একুশে ফেব্রুয়ারি"

-ফারুক আহম্মেদ জীবন 


আজ অমর২১শে-ফেব্রুয়ারী । আন্তর্জাতিক মাতৃ ভাষা দিবস। দশ বছর বয়সের ছোট্ট রিংকু ওর দাদা আশা মণ্ডলের সাথে গেছে ঢাকা সাভারের নবীনগরে জাতীয় স্মৃতি সৌধে। ভাষা শহীদদের  আত্মার মাগফিরাত আর তাদের শ্রদ্ধা স্মরণে পুষ্প মাল্য হাতে নিয়ে ।যেতে যেতে রিংকু ওর দাদুর কাছে জিজ্ঞাসা করলো আচ্ছা দাদু, ২১শে ফেব্রুয়ারীর আজকের এ দিনে কি ঘটেছিল? যেজন্য আমরা সকলে আজ স্মৃতি সৌধে যাচ্ছি পুষ্প ডালি নিয়ে? রিংকুর দাদু তখন বললো: সে বাঙালীদের অনেক কষ্টদ্বায়ক স্মৃতি বিজড়িত এক ঘটনা দাদু ভাই। তাহলে বলছি শোন..তারপর স্মৃতি সৌধে যেতে যেতে কল্পনা করে রিংকুকে বলতে লাগলো...। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। ১৯৫২ সাল। ঢাকার শহর পুরোটাই থমথমে ভাব
বিরাজ করছে। পাকিস্তানি সরকার ১৪৪ ধারা কঠিন আইন জারি করেছে পূর্ব বাংলার বাঙালী -দের উপর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কোথাও কোনো জনসমাবেশ, মিছিল-মিটিং করা নিষেধ।একসাথে  কোথাও কোনো মানুষের জটলা বাঁধতে দেখলে গ্রেফতার করার নির্দেশ পরোয়ানা জারি করেছে। কলেজের ক্যাম্পাস তাই পুরোই ফাঁকা। কিন্তু এমন ভয়ার্ত মুহূর্তেও থেমে নেই পূর্ব বাংলার সাহসী দামাল ছেলে-মেয়েরা। ওরা একে-অন্যের সাথে গোপনে খুব সাবধানে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে। কলেজ গুলো বন্ধের পর কেউ- কেউ আবার প্রাণের ভয়ে শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছে। 
এরকমই ভয়াবহ মুহূর্তের গভীর এক রাত। চারি-দিকে নিস্তব্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনতিদূরে শহরের  প্রথম গলির পাশেই তরুণদের বাড়ি। সে তার আলো আবছা রুমটিতে উদ্বিগ্ন অবস্থায় একাকি পায়চারি করছে। তরুণের মা প্রভাত রাণী এসে বললো; বাবা তরুণ আর জেগে থাকিসনে ঘুমিয়ে পড়। তরুণ: তুমি গিয়ে ঘুমাও মা। আমি এখুনি ঘুমাবো। প্রভাত রাণী বললো: আচ্ছা, তারপর চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দরজায় ঠুকা দিয়ে বললো...এই তরুণ..তরুণ..এই তরুণ দরজা  খোল আমি বাদল। তরুণ বাদলের কন্ঠ শুনে দ্রুত  দরজা খুলে দিল।দরজা খুলতেই বাদল দ্রুত রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তরুণ উৎকন্ঠা হয়ে জিজ্ঞাসা করলো: কিরে তুই একা কেন? আকাশ, বর্ষা, সাগর, দ্বীপ, নদী, পর্বত ওরা কই?  বাদল বললো:ওরা সব এখুনি এসে পড়বে। ওদের কথা শেষ হতে না হতেই এক-এক করে সকলে আসতে লাগলো। প্রথমে, তরুণ বললো: যেজন্য তোদের সকলকে এখানে ডেকেছি। আর তা-হলো পাকিস্থানী সরকার যে চক্রান্ত শুরু করেছে। তা- যদি আমরা কোনো ভাবে মেনে নিই। তাহলে কিন্তু  আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলা চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলবো। বর্ষা বললো: পাকিস্তানি  সরকারের এমন অন্যায় দাবী মেনে নেওয়া যায় না। পর্বত বললো: আমরা পূর্ব বাংলার বাঙালীরা কেনো তাদের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা মেনে নেবো? আকাশ বললো: তুই ঠিক বলেছিস পর্বত। আমরা আমাদের মায়ের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে ওদের উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা মানবো না।
আকাশ বললো: আমরা কালকেই ওদের ১৪৪
ধারা ভেঙ্গে প্রতিবাদ মিছিল বের করবো।ওদের মধ্যে আকাশ নামের ছেলেটি খুব সাহসী। নদী বললো; আকাশ ওরা কিন্তু গুলি ছুড়তে পারে।
আকাশ বললো: গুলি করলে করবে। বুকের রক্ত দিয়ে। জীবন দিয়ে হলেও মায়ের ভাষা বাংলাকে
রক্ষা করবো। তবু ওদের অন্যায় দাবি মেনে নেবো
না। তরুণ বললো: সত্যি আজ আমি মুগ্ধ হয়েছি।
তোদের মনোবল দেখে। মাতৃভাষা বাংলার প্রতি 
তোদের এতো টান ভালোবাসা দেখে। তুরা ঠিক বলেছিস।জন্মের পর যে ভাষায় আমরা কথা বলা শিখেছি। আমাদের কারোর জীবন থাকতে সেই 
ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাকে আমরা রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে মানিনা। 
দ্বীপ বললো: আরে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার
স্বরবর্ণ অ, আ, ই, ঈ, ব্যঞ্জনবরর্ণ ক, খ, গ, ঘ,
এসে যে প্রাণ আছে। মাকে মা বলে ডাকা৷ বাবাকে
বাবা বলে ডাকার মধ্যে যে শান্তি আছে। তা- কি
অন্য কোনো ভাষায় খুঁজে পাবো আমরা বল?
তরুণ বললো: একদম ঠিক বলেছিস। 
আয় সকলে মিলে শপথ করি। তারপর ডান হাত
এগিয়ে দিলো তরুণ। 
ওরা সকলে তরুণের হাতের উপর একে- একে হাত রাখলো। প্রথমে তরুণ বলতে লাগলো। তা- শুনে একসাথে সকলে সমকন্ঠে প্রতিজ্ঞা করে
বলতে লাগলো....
আমরা আমাদের জীবন থাকতে...
আমাদের কারোর দেহে একবিন্দু রক্ত থাকতে
মাতৃভাষা বাংলাকে হারাতে দেবো না। 
উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা মেনে নেবো না...নেবো না..
বুকের রক্ত দিয়ে হলেও বাংলা ভাষাকে
রাষ্ট্র ভাষা করবো।
তারপর সকলে হাত সরালো।ঐ রাতে মিটিং শেষে সকলে বিদায় নিয়ে খুব সাবধানে যে -যার গন্তব্যে চলে গেলো। রাতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারপরদিন
অর্থাৎ বাংলা ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের  ৮-ই ফাল্গুন বৃহস্পতিবার সকালে। একে-একে সকলে হাজির
হতে লাগলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রঙ্গণে। কলেজের অনেক শিক্ষক,  ব্যবসায়ী, শ্রমিক, কৃষকও যোগ
দিলো। 
একসময় ওরা সকলে বাংলা বর্ণমালার পোস্টার
আর রাষ্ট্র ভাষা উর্দু মানিনে...
রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই। এরকম পোস্টার হাতে স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে গেলো। হঠাৎ মিছিলের উপর বৃষ্টির মতো মুহুর্মুহু বিকট গুলির শব্দ। অনেকে পোস্টার হাতে রক্তাক্ত দেহে লুটিয়ে পড়ল পিচঢালা রাজপথে। বাঙালীর রক্তে রঞ্জিত 
হয়ে উঠলো রাজপথ। বাংলা ভাষার জন্য শহীদ হলো, সালাম, জব্বর, রফিক, শফিক, বরকত   এমন আরো অনেকে। জীবিত যারা ছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ মিছিল থেকে গ্রেফতার হলো। এ খবর ছড়িয়ে পড়তে আমাদের পূর্ব বাংলার সকল স্কুল, কলেজের শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীরা ও আপামর জনতা রাজপথে নেমে পড়লো।একপর্যায়ে ওরা
বাঙালীদের তোপের মুখে টিকতে না পেরে হার মানলো। অনেক ভাষা শহীদদের বুকের রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের মাতৃ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে ফিরে পেলাম। ততক্ষণে রিংকু ওর দাদুর সাথে জাতীয় স্মৃতি সৌধে পৌঁছে গেল। সব শুনে রিংকু বললো: ও বুঝতে পেরেছি দাদু এজন্য আমাদের মাতৃ ভাষা বাংলার জন্য জীবন
উৎসর্গকারী ভাষা শহীদদের ভালোবেসে তাদের
শ্রদ্ধা জানাতে আমরা শহীদমিনার স্মৃতি সৌধে আসি তাইতো দাদু? আশা মণ্ডল বললো: হুম দাদু
তুমি ঠিকই বুঝেছ। ভাষা শহীদদের সম্মানার্থে 
তাদের স্মরণে গভীর শ্রদ্ধা জানাতে আমরা আসি।

 

Post a Comment

0 Comments