প্রতিদিন চরকা

প্রতিদিন চরকা

মাদকে সমাজ সয়লাভ -ইমতিয়াজ আহমেদ

 


বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকা বর্তমানে মাদকে সয়লাভ। শহর, বন্দর, গ্রাম সর্বত্রই আজ মাদক নীলথাবা বিস্তার করেছে। এমন কোন এলাকা নেই যেখানে মাদক নেই। হাত বাড়ালেই মিলে মাদক। প্রতিদিন হরেকরকম মাদকের চালান দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাচ্ছে। কৌশলে তোলে দেয়া হচ্ছে পথশিশু থেকে শুরু করে কিশোর কিশোরী, তরুন তরুনীসহ সকল বয়সী মাদকসেবীদের হাতে। মাদক ব্যবসায়ীরা অবলীলায় মাদক ব্যবসা করছে সকলের নাকের  ডগায়। কোথাও কোথাও মাদক এখন পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অর্থাৎ কোন কোন পরিবারের সকল সদস্যই মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। এই হচ্ছে মাদকের বর্তমান ভয়াবহ চিত্র।

প্রথম আলো পত্রিকায় গত ২৬ জুন ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,  মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক গবেষণার ফলাফল অংশে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দেশে প্রাক্কলিত মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৮৩ লাখ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ। 
এই পরিসংখ্যান দেশের মাদক পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি নির্দেশ করে। এই পরিসংখ্যান এটাই প্রমাণ করে যে, দেশে মাদক একেবারেই নিয়ন্ত্রণে নেই। মাদক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর কার্যকর উদ্যোগ না থাকার কারণে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে (জনসংখ্যা ধরা হয়েছে সর্বশেষ জনশুমারি ও গৃহগণনা শুমারি অনুযায়ী ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ৩০ হাজার)।

মাদক হচ্ছে অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু। মাদকের কারণে বাড়ছে চুরি, ছিনতাই, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ড। এতে দিনদিন অবনতি ঘটছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। কখনো কখনো মাদক ব্যবসায়ীরা মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘর্ষ খুনাখুনিতে লিপ্ত হচ্ছে। মাদক ধ্বংস করছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, জাতি। তরুন প্রজন্মের একটি বৃহৎ অংশ আজ মাদকাসক্ত। একজন মাদকসেবী স্বাভাবিক জীবন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। মাদকের নেশার কারণে অন্যদের সাথে তার স্বাভাবিক সম্পর্কটা থাকে না। মাদকের নীলথাবায় ধ্বংস করে ফেলে নিজেকে। একটি পরিবারে একজন মাদকাসক্তের কারণে সে পরিবারের শান্তি চলে যায় নির্বাসনে। মাদকাসক্ত সদস্যটি মাদক ক্রয়ের অর্থ জোগানো জন্য পিতামাতার উপর চাপ সৃষ্টি করে। অর্থ না পেলে উগ্র মেজাজে ঘরে ভাংচুর চালায়। কখনো কখনো মাদকাসক্ত সন্তান জন্মদাতা পিতামাতাকে হত্যা পর্যন্ত করে ফেলে। এমন লৌহমর্ষক ঘটনার খবর মাঝেমধ্যে প্রচারমাধ্যমে উঠে আসে। কখনো কখনো অতিষ্ঠ হয়ে অসহায় পিতা মাদকাসক্ত সন্তানকে থানায় নিয়ে যাওয়ার ঘটনা আমরা জানতে পারি। মাদকাসক্তের সংখ্যা দিনদিন বাড়ার কারণে সমাজে ধর্ষণ, নারী উত্যক্তকারীর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। চলার পথে আজ কোন নারী নিরাপদ নয়। সমাজে ধর্ষণ, নারী উত্যক্তের সংখ্যা বাড়ার পেছেনে রয়েছে মাদকের কুপ্রভাব।

একদিকে মাদকে ধ্বংস হচ্ছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ জাতি অপরদিকে মাদক ব্যবসা করে অবৈধ টাকার কুমির হচ্ছে মাদক ব্যবসায়ী এবং তাদের আশ্রয় প্রশ্রয়দাতারা। মাদক এখন পারিবারিক ব্যবসা হিসেবেও দেখা দিয়েছে। পরিবারের সকল সদস্য মাদক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়ছে। পরিবারের সকলে মিলেমিশে করছে মাদক ব্যবসা। অবৈধ টাকার লোভে নিমজ্জিত হয়ে এরা জাতি ধ্বংসে নেমেছে।

যে কোন অবৈধ ব্যবসার আশ্রয় প্রশ্রয়দাতা থাকে। আশ্রয় প্রশ্রয়দাতা ছাড়া অবৈধ ব্যবসা সম্ভব নয়। প্রশ্ন হলো, মাদক ব্যবসার আশ্রয় প্রশ্রয়দাতা কারা? প্রশাসনের দুষ্টুচক্র, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুষ্টুচক্র ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলের দুষ্ঠুচক্র এই তিন দুষ্টুচক্র মাদক ব্যবসার আশ্রয় প্রশ্রয়দাতা। এদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে মাদক ব্যবসা চলে দেদারসে। রাষ্ট্রে যদি এ ধরণের আশ্রয় প্রশ্রয়দাতা থাকে তাহলে  মাদক কোনদিনই নির্মূল হবে না। কারণ, এই আশ্রয় প্রশ্রয়দাতারা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রযন্ত্রেই বাস করে। 

অতীতে মাদক অনেকটা শহরকেন্দ্রিক ছিল। বর্তমানে শহর, বন্দর, গ্রাম সর্বত্রই মাদকের ছড়াছড়ি। এমন কোন মাদক নেই যা বর্তমানে গ্রামে নেই। গ্রামে দিনদিন মাদকসেবীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রত্যন্ত গ্রামগুলো বর্তমানে মাদক গুদামজাত করার নিরাপদ স্থান হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। গ্রাম খোলামেলায় হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পৌঁছার আগেই সোর্সের মাধ্যমে মাদক ব্যবসায়ীরা খবর পেয়ে যায়। এতে সহজেই মাদক সরিয়ে নিতে পারে বিকল্প স্থানে। 

অনেক সময় দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করছে। আদালতে চালানও দিচ্ছে। প্রশ্ন হলো, গ্রেফতার করছে কাদের? গ্রেফতার করছে মাঠ পর্যায়ের খুচরা বিক্রেতাদের। কিন্তু রাঘববোয়ালদের গ্রেফতার করছে না। রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। রাঘববোয়ালদের গ্রেফতার না করার কারণে কোন কোন খুচরা বিক্রেতাকে গ্রেফতার করলেও মাদক ব্যবসায় এর কোন প্রভাব পড়ে না। বরং মাদক সিন্ডিকেট গ্রেফতারকৃত মাঠপর্যায়ের খুচরা মাদক ব্যবসাযীকে ক'দিন পরেই জামিনে বের করে নিয়ে আসে। জামিনে বেরিয়ে এসে আবার মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে যাচ্ছে। এই হলো গ্রেফতার ও জামিনে বেরিয়ে আসার লুকোচুরি খেলা, যে খেলা সাধারণ মানুষ দেখছে। 

মাদকের সহজলভ্যতার কারণে দিনদিন মাদকসেবীর সংখ্যা বাড়ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে। মাদকের নীলথাবায় প্রজন্মের একটি বৃহৎ অংশ আজ অন্ধকারে ডুবছে। এর থেকে উত্তরন দরকার। উত্তরন ঘটাতে না পারলে তার কুফল ভোগ করতে হবে জাতিকে। উত্তরনের পথ কি? যে পথ মাদক নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। প্রথমত: রাষ্ট্রযন্ত্রকে কঠোরভাবে মাদক সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিতে মাদক বিরোধী অভিযান সবসময়ই চালু রাখতে হবে। কাউকেই ছাড় দেয়ার কোন সুযোগ রাখা যাবে না। মাদকবিরোধী গণসচেতনা কার্যক্রম গতানুগতিকভাবে না করে জোরদারভাবে করতে হবে। মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে সারাবছর সকলপ্রকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাটহাজার সহ সর্বত্র মাদকবিরোধী প্রচারাভিযান চালাতে হবে। এছাড়া, মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুষ্টুচক্রের বিরুদ্ধে জেল, চাকুরিচ্যুতির মত কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। 

মাদক নির্মূলে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। রাজনীতি যেহেতু মানুষের জন্য তাই মানুষের কল্যাণার্থে মাদক নির্মূলে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে। দলের কোন দুষ্টুচক্র মাদক ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত থাকলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজনৈতিক দুষ্টুচক্র দলীয়ভাবে সাংগঠনিক ব্যবস্থার মুখোমুখি হলে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাঝে প্রভাবে কাটাতে পারবে না। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার কারণে দলীয়ভাবে মাদকবিরোধী প্রচারাভিযান চালাতে হবে। 

স্থানীয়ভাবে যেসব সংগঠন ও ক্লাব রয়েছে তাদেরকে মাদকবিরোধী সচেতনামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে সুস্থ সমাজের স্বার্থে। একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। মাদক নির্মূলের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলে মাদক ও মাদক ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধে সচেতন নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে, যা নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব ও কর্তব্য। সুস্থ সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন ব্যতীত কোন বিকল্প নেই। তাই নিজ নিজ এলাকায় নিজ নিজ সমাজে নিজ দায়িত্বে মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলতে হবে। সচেতন জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে মাদক নির্মূল হবেই। যেখানেই মাদক সেখানেই প্রতিরোধ -এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে নি:শঙ্কচিত্তে সচেতন জনতাকে জাগ্রত থাকতে হবে।

চারিদিকে আজ মাদকের যে নীলথাবা তার থেকে মুক্তি একান্ত জরুরি। মাদক নির্মূল করতে না পারলে তার কুফল জাতিকে ভোগ করতে হবে। তাই মাদক নির্মূলে সকলে এগিয়ে আসতে হবে এবং যথাযথ দায়িত্ব পালনে সক্রিয় হতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।

লেখক পরিচিতি: সভাপতি, সমাজ রূপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘ, ময়মনসিংহ।

Post a Comment

0 Comments