ইতিহাসের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে কবি এমদাদ খাঁন সাহেবের নেতৃত্বে নেত্রকোণা থেকে জনাব হাবিবুর রহমান ভূইয়া (ব্যাংক কর্মকর্তা অবঃ, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক), আলতাবুর রহমান (ব্যাংক কর্মকর্তা অবঃ, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক), মোঃ আতিকুর রহমান আতিক (সহকারী শিক্ষক, ইচুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, পূর্বধলা নেত্রকোণা), মোঃ মঞ্জুরুল হক খান (সমাজসেবী) মোঃ মুখলেছুর রহমান জাহাঙ্গীর (সহকারি শিক্ষক, লক্ষীপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, নেত্রকোণা) যোগীর গুহায় পৌঁছেন। সেখানে পাগলপন্থী কৃষক বিদ্রোহের জনক করম শাহ্ পাগলপন্থী ফকিরের উত্তর পুরুষ জনাব মোঃ চাঁন মিয়া ফকির (শিক্ষক, গবেষক প্রাবন্ধিক), জনাব সাইফুল ইসলাম ফকির (প্রধান শিক্ষক, তেনুয়া উচ্চ বিদ্যালয়, পূর্বধলা, নেত্রকোণা), জনাব মোঃ আব্দুস ছালাম ফকির (সমাজসেবী), জনাব মোঃ উমর ফারুক ফকির (সংস্কৃতিকর্মী), তাঁদেরকে সাদরে গ্রহণ করেন। পরে সবাই সাইফুল ইসলাম ফকির সাহেবের বাড়ীতে চা- চক্রে অংশ নেন।
ভ্রমণের শুরুতেই আমাদের সাথে যোগ দেন পাগলপন্থী ফকির পরিবারের বধূ শিরীন আক্তার (লেখক, গবেষক)। প্রথমেই আমরা পাগলপন্থী কৃষক বিদ্রোহের জনক করম শাহ পাগলপন্থী ফকির এর প্রথমা স্ত্রীর সমাধি পরিদর্শন করি। করম শাহ এর জেষ্ঠ্যপুত্র ছফ্যাতি শাহ পাগলপন্থী ফকির তাঁর মাকে নিয়ে যোগীর গুহায় এসে আত্মগোপন করেছিলেন। ঐতিহাসিক যোগীর গুহা গ্রামটি বর্তমান নেত্রকোণা জেলার পূর্বধলা উপজেলার ১২নং বৈরাটী ইউনিয়নে অবস্থিত। এটি সুরিয়া নদীর উত্তর তীরে ও নদী সংলগ্ন বাউশাইল বিলের উত্তর ও পশ্চিম পাশে অবস্থিত। সুরিয়া নদীটি মোঘল আমলে গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ ছিল। এই পথেই স্বাধীন শাসক ওসমান খান তাঁর সৈন্য বাহিনী নিয়ে বোকাইনগর দুর্গ (তখন এটি রাজধানী ছিল) থেকে সিলেটের লাউড়ে চলে গিয়েছিলেন। ছফ্যাতি শাহ পাগলপন্থী ফকির তাঁর বসবাসরত মনোরম এই যোগীর গুহা গ্রামটি পীরোত্তর ভূমি (পীরেপাল ননবাদশাহি লাখেরাজ) হিসেবে পেয়েছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর লক্ষ্য ছিল অধিক মুনাফা অর্জন তাই বিভিন্ন চুতায় লাখেরাজ সম্পত্তির বাজেয়াপ্তি করণ চলে। ফলে যোগীর গুহা গ্রামের পীর রাখেরাজ ভূমিও বাজেয়াপ্তির কবলে পড়ে। পীরোত্তর গ্রাম যোগীর গুহা এর পীর লাখেরাজ ভূমির সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ছফ্যাতিশাহের পৌত্র মজম ফকির। তবে এখনও পীরমাতার (ছফ্যাতি শাহ পালগপন্থী ফকির এর মা) সমাধি সংলগ্ন কিছু ভূমি পীরপাল ভূমি হিসেবে আছে। (সূত্র প্রবন্ধ যোগীর গুহা, প্রতিদিনের কাগজ, সোমবার ০৩ মে, ২০২১ খ্রী., প্রবন্ধ যোগীর গুহা, সাপ্তাহিক চরকা রবিবার ১৬ এপ্রিল ২০২৩ খ্রী.। আমরা ঐতিহাসিক সুরিয়া নদীর পাড়ের প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন ও ছবি তুলেছি।
সি.এন.জি ও মোটর সাইকেল যোগে আমরা চিমুরানীর দিঘি দেখতে যাই। এটি সিংরাউন্দ গৌরীপুর, ময়মনসিংহ এ অবস্থিত। মোগল দেওয়ান মনসবদার উমর খাঁ এর দুর্গ ও আবাস কেল্লা তাজপুর (ঐতিহাসিক সুরিয়া নদীর তীরে) গ্রামের পাশেই এই সিংরাউন্দ গ্রামটি। এই স্থানে প্রায় ২৫ একর জমির উপর কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চিমুরানীর দিঘী। এই দিঘীটি ঘিরে লোকমুখে প্রচলিত আছে অনেক কাহিনী। কথিত আছে চিমুরানী ছিলেন দেওয়ান উমর খাঁর বোন। উমর খাঁ তাঁর বোনের কোমরে সুতা বেঁধে দিয়ে বলেছিলেন যে পর্যন্ত যাবেন সে পর্যন্তই হবে দিঘীর আয়তন। যেতে যেতে এক জায়গায় জোঁকের ভয়ে লাফ দিলে সুতা ছিড়ে যায় এবং সেখানেই দিঘীর পরিধি নির্ধারণ করা হয়। (সূত্র:- আমাদের গৌরীপুর, প্রথম প্রকাশনী- ৪ আগস্ট ২০১২, গৌরীপুর সমিতি, ময়মনসিংহ। সেখান থেকে আমরা যাই সুমন দেওয়ানের ফিশারীতে। সুমন দেওয়ান আমাদের আপ্যায়ন করেন। আপ্যায়ন শেষে আমরা যাই ভূটিয়ারকোনা সাধারণ পাটাগার গৌরীপুর, ময়মনসিংহে। পাঠাগারের সভাপতি জনাব এম.এ কুদ্দুছ পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক আজিবুর রহমান, অধ্যাপক মহিউদ্দিন মুকুল আমাদেরকে সাদরে গ্রহণ করেন। পাঠাগারে আসলে সেখানে জনাব এম.এ. কুদ্দুছ সাহেবের আতিথিয়তায় আমরা মুগ্ধ। সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন- জনাব মোঃ সাজেদুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ভূটিয়ারকোনা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, জনাব মোঃ আতিকুল ইসলাম গ্রন্থাগারিক। ১৯৭৮ খ্রীস্টাব্দে জনাব আব্দুল খালেক (ভুটিয়ার কোনা) সাহেবের দানকৃত ৫ শতক ভূমিতে জনাব সাইদুর রহমান মাস্টার ও এম.এ কুদ্দুছ সাহেবের নেতৃত্বে এলাকার সচেতন যুব সম্প্রদায় ভুটিয়ার কোনা সাধারণ পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে পাঠাগারের জন্য পাঠাগার কর্তৃপক্ষ আরো ০৮ শতক ভূমি ক্রয় করেন। পাঠাগার পরিচালনা প্রথম কমিটির সভাপতি ছিলেন সাইদুর রহমান মাস্টার, সম্পাদক ছিলেন এম.এ কুদ্দুছ। পাঠাগারের প্রথম সদস্য আব্দুর রহমান (ফালুয়া হাটী)। পাঠাগারের আনুষ্ঠানিক যাত্রায় উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে ছিলেন অধ্যাপক গোলাম সামদানী কোরায়াশী, অধ্যাপক যতীন সরকার ও হাফিজউদ্দিন আহাম্মদ (শিক্ষক ময়মনসিংহ জিলা স্কুল)। পাঠাগারের পাশ্ববর্তী বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও এলাকার লোকজন এই সমৃদ্ধ পাঠাগারে বই পড়ার সুযোগ পান। পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা ৪৫৬৪টি এবং দৈনিক জাতীয় পত্রিকা থাকে ৪টি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর, ঢাকা এর নিবন্ধন অনুসারে নিবন্ধন নম্বর ম-০১৭৭৬, তারিখ: ২০/০১/২০১০খ্রি., গ্রন্থাগার অধিদপ্তর, ১০, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, শাহবাগ, ঢাকা তালিকাভূক্তিকরণ সনদ অনুসারে তালিকাভূক্তিকরণ নম্বর: বিসসগ্র/ময়মন/২৯, তারিখ: ০৭/১০/২০২০খ্রি.। জনাব এম.এ. কুদ্দুছ সাহেবের পরিবেশিত পায়েস, মুড়ি ও চা পানের পর সজিব প্রাণবন্ত হয়ে আমরা চলে যাই বীরাঙ্গনা সখিনার সমাধি স্থলে। এটি কুমড়ি গ্রামে অবস্থতি। প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশে বীরাঙ্গনা সখিনার সমাধি। ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলার কেল্লা তাজপুরের মোগল মনসবদার দেওয়ান উমর খাঁর কন্যা এই কন্যাই ছিলেন মৈমনসিংহ গীতিকার বীরঙ্গনা সখিনা। বাল্যকাল থেকেই তিনি পিতার কাছে যুদ্ধবিদ্যা রপ্ত করেন। অসি চালনা, ঘোড়ায় চড়ায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। তিনি কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ির ঈসা খাঁর অন্যতম পৌত্র ফিরোজ খার বীরত্বগাথায় মুগ্ধ হন এবং জনৈকা নারী দূতিকা মারফত তাঁর ছবি দেখে তাঁর প্রেমে পড়েন। কিন্তু মোগল মনসবদার পিতা মোগলদের চিরশত্রু ঈসা খাঁর বংশধরের সাথে আত্মীয়তায় অস্বীকৃত হন। নিরুপায় সখিনা পিতার অমতেই ফিরোজ খাঁকে বিয়ে করেন।
এই বিরোধের জের জঙ্গলবাড়ির ফিরোজ খাঁর সাথে উমর খার বিরোধ চরমে উঠে। ফলে তাজপুরের প্রান্তরে উভয় পক্ষের যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে ফিরোজ খাঁ পরাস্ত হয়ে উমর খাঁর নিকট বন্দী হন। প্রিয়তম স্বামীর পরাজয়ের সংবাদ জঙ্গলবাড়ি পৌঁছলে স্ত্রী সখিনা পুরুষের বেশে রণসাজে সজ্জিত হয়ে অশ্বারোহণে দ্রুত বেগে রণক্ষেত্রে পৌঁছেন। পিতা উমর খাঁর সৈন্যদলের বিরুদ্ধে প্রবল রণহুঙ্কারে অসি চালনা করতে থাকেন। এক পর্যায়ে যুদ্ধের গতি আপন অনুকূলে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। ঠিক সেসময় উমর খাঁর একজন দূত সাদা পতাকা হাতে তাঁকে যুদ্ধ থামাতে বলেন। দূত তাঁকে জানান যে যুদ্ধের কারণ সখিনার বিয়ে, তাঁর সমাধান হয়ে গেছে অর্থাৎ সখিনার স্বামী ফিরোজ খাঁ তাঁকে তালাক দিয়েছেন।
যে প্রেমিক স্বামীকে পিতৃ বন্দীশালা থেকে উদ্ধারকল্পে ও স্বামী-পরিবারের মর্যাদা রক্ষার জন্য পুরুষের ছদ্মবেশে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তিনিই কি না তাঁকে পরিত্যাগ করেছেন“ এ সংবাদে তীব্র মানসিক আঘাত সইতে না পেরে সখিনা অশ্বপৃষ্ঠ থেকে বেহুঁশ হয়ে মাটিতে পড়ে যান এবং পরক্ষণেই তাঁর প্রাণবায়ু দেহপিঞ্জর থেকে অনন্তে মিলিয়ে যায়। আসলে জঙ্গলবাড়ির দেওয়ান ফিরোজ খাঁ সখিনাকে তালাক দেন নি, বরং পিতার ওমর খাঁ শঠতা করে যুদ্ধরত অচেনা যুবককে রণসাজে ছদ্মবেশেী সখিনাকে এই মিথ্যা সংবাদ শুনান।
পুরুষের বেশে রণসাজে সজ্জিত সখিনা তালাক প্রাপ্তির সংবাদ শুনে সংজ্ঞা হারিয়ে ভূলুন্ঠিতা হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ভূতলশায়িনী মৃত সখিনার শিরস্ত্রাণ আলগা হয়ে তাঁর ছদ্মবেশ উন্মোচিত হয়ে পড়ে। মৃত ব্যক্তি যে অমর খাঁর কন্যা সখিনা এ কথা যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। একমাত্র আদুরে বীর কন্যার আকস্মিক মৃত্যুর কথা শুনে অমর খাঁ ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পেরে কনের নিষ্প্রাণ দেহের ওপরে আছড়ে পড়ে আর্তনাদ করতে থাকেন। বন্দী ফিরোজ খাঁও মুক্তি লাভ করে সখিনাকে হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে পড়েন।
আত্মমর্যাদাশীল সাহসী নারী বীরাঙ্গনা সখিনা যুদ্ধক্ষেত্রের যেখানে ভুলুণ্ঠিতা হয়ে জীবনলীলা সাঙ্গ করেছিলেন, সেখানেই তাঁর দেহ সমাহিত করা হয়। এক বিয়োগান্ত কাহিনীর অমর নায়িকার শেষ শয্যাস্থল বহু দর্শনার্থীর চোখ আজো অশ্রুসজল করে তুলে। (সূত্র: বৃহত্তর ময়মনসিংহের ইতিহাস - মো. রফিকুল হক আখন্দ)। বীরঙ্গনার সখিনার সমাদি ও শতবর্ষী কাঠগোলাপের গাছ এখনও যে তাঁর স্মৃতি বহন করছে আমরা সবাই ঘুরে ফিরে তা দেখলাম ও উপলব্ধি করলাম।
বীরঙ্গনা সখিনার সমাধি স্থল থেকেই আমাদের পুরোটিম ফিরে চলে আসলাম যোগীর গুহায় মোঃ চাঁন মিয়া ফকির সাহেবের বাড়িতে। আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে সেখানে বিশ্রাম ও ভ্রমণের বিভিন্ন দিক, ঐতিহাসিক স্থানের নমুনার সাথে ঘটনার মিল অমিল ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা শেষে টিম লিডার কবি এমদাদ খাঁন সাহেবের নেতৃত্বে টিম নেত্রকোণা উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন




0 Comments