চরকা ডেস্ক ঃ
"আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে"
প্রেম, দ্রোহ ও সাম্যের কবি নজরুলের লেখা এই দুটো চরণের বাস্তব সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার দরিরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়, বিচুতিয়া ব্যাপারি বাড়ি, কাজির শিমলা দারোগা বাড়ি ও নামাপাড়ার শুকনিবিলের পাশের বট গাছটি। আজ থেকে শত বছরেরও বেশি সময় আগে ১৯১৪ সালে নজরুল এই অঞ্চলে অল্প কিছু দিনের জন্য অবস্থান করেছিলেন এবং এক অজ্ঞাত কারণে ফিরে গেছেন তিনি। পরে আর কখনো তিনি এখানে ফিরে আসেননি। তবুও তার স্মৃতি ভুলতে পারেনি এই অঞ্চলের মানুষ। নজরুল চিরতরে চলে গেলেও এই অঞ্চলের মানুষ নজরুলের স্মৃতিকে ধারণ করছে নানা ভাবে। এখানে নজরুলের নাম, নজরুলের সাহিত্য কর্ম, বই, কবিতা ইত্যাদি নামে গড়ে ওঠেছে নানা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং স্থাপনা।
কাজির শিমলা দারোগাবাড়ি-
কাজির শিমলা দারোগাবাড়ির রফিজউল্লাহ দারোগার হাত ধরে কবি নজরুল এই অঞ্চলে প্রথম আসেন। বিভিন্ন লেখনি থেকে জানা যায়, ১৯১১ সালে কবি নজরুল যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে কলকাতার মাথরুন স্কুলে পড়েন তখন অর্থাভাব লাঘব করার জন্য তিনি রুটির দোকানে মাসিক এক টাকা বেতনে চাকরি নেন। টাকা এবং খাবার দেবে কিন্তু থাকার জায়গা দেবে না এই শর্তে কাজ নেন নজরুল। ফলে কোনও উপায় না দেখে নজরুল আসানসোলের রুটির দোকান সংলগ্ন একটি তিনতলা বাড়ির বারান্দায় সিড়ির নিচে রাত্রি যাপন করতেন। ওই বাড়িতেই থাকতেন ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার কাজীর শিমলা গ্রামের পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর কাজী রফিজ উল্লাহ। কাজী সাহেব একদিন সিঁড়ির নিচে ঘুমন্ত নজরুলকে দেখে কৌতুহলী হয়ে পড়েন এবং নজরুলের জীবন কাহিনী শুনেছিলেন। রফিকুল ইসলামের লেখায় পাওয়া যায়, দারোগা সাহেব নাকি নজরুলকে পাঁচ টাকা বেতনে বাড়ির কাজে নিযুক্ত করেন কিশোর নজরুলকে। তখন পর্যন্ত দারোগা এবং তার স্ত্রী শামসুন্নেছা দম্পত্তি ছিলেন নিঃসন্তান। নজরুল দারোগাকে তাঁর পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। নজরুলের অনুরোধে আবেগাপ্লুত হয়ে কাজী সাহেব তার বড় ভাই কাজী সাখাওয়াতউল্লাহকে পত্রযোগে নজরুলকে ত্রিশালের কাজীর শিমলায় পাঠিয়ে দেন স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য। এভাবে নজরুলের আসানসোলের রুটির দোকান এবং কাজী রফিজউল্লাহের বাড়ির চাকরির সমাপ্তি ঘটে নজরুল আসেন ত্রিশালের কাজির শিমলা। কবির স্মৃতিবিজড়িত কাজির শিমালার রফিজউল্লাহ দারোগা সেই বাড়ির আঙিনায় সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে নজরুল পাঠাগার ও স্মৃতি ভবন। সংরক্ষণ করা হয়েছে নজরুল যে খাটে ঘুমাতেন; সেই খাটটিও। জনবল সংকটে ভুগছে প্রতিষ্ঠানটি। দুরদুরান্তের পর্যটকরা হতাশ হয়ে ফিরে যান। এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে রয়েছে ক্ষোভ।
নজরুল একাডেমি:
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে কাজির শিমলার রফিকউল্লাহ দারোগা ময়মনসিংহের এ অঞ্চলে নিয়ে এসে যেখানে ভর্তি করিয়েছিলেন তা বর্তমান ত্রিশাল সরকারি নজরুল একাডেমি । পূর্বে নাম ছিল দরিরামপুর হাই স্কুল । দারোগা সাহেবই ১৯১৪ সালের সালের জুন মাসে কাজী নজরুল ইসলাম ও ছোট ভাই কাজী আবুল হোসেনকে দরিরামপুর ইংরেজি হাইস্কুলেভর্তি করিয়েছিলেন তৎকালীন দরিরামপুর উচ্চ বিদ্যালয় বর্তমানে যা নজরুল একাডেমি।
কবি নজরুল জীবিত থাকা অবস্থায় এবং জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার আগেই ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে এই স্কুলের নামকরণ করা হয়েছে ত্রিশাল সরকারি নজরুল একাডেমি। ২০১৮ সালে মাধ্যমিক বিদ্যালয়টিকে সরকারিকরণ করা হয়। এছাড়াও দরিরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের যে দু’টি শ্রেণিকক্ষে কবি পড়াশনা করতেন। সেই দু’টি শ্রেণিকক্ষ এখনো রয়েছে আগের মতোই। স্কুলের পাশে নজরুলের নামে নজরুল ডাক বাংলো, নজরুল মঞ্চ এবং ঈদগাঁ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
বিচুতিয়া বেপারীর বাড়ি এবং নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র-
নজরুল দরিরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য বিচুতিয়া বেপারীর বাড়িতে জায়গীর থাকেন। বেপারী বাড়ির পূর্ব দিকে একটি ছোট পুকুর ছিল। সেই ঘরেই নজরুল থাকতেন। অবশ্য পুকুরটিতে নজরুল গোসল করতেন না। পাশের বাড়ির আরেকটা পরিষ্কার পানির পুকুরে তিনি গোসল করেছেন। কবির স্মৃতিবিজড়িত এ বাড়িতেই তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে তিনতলা বিশিষ্ট ‘নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র’। প্রথম তলায় অডিটোরিয়াম, দ্বিতীয় তলায় অফিস রুম এবং তৃতীয় তলায় লাইব্রেরি রয়েছে। এছাড়াও কবি যে ঘরে ঘুমাতেন; সেই ঘরটি পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছে। পাশেই একটি পুকুর খনন করা হয়েছে। এখানেও রয়েছে জনবল সংকট। একজন মালি ছাড়া কাউকে পাওয়া যায় না। জনবল সংকটের বিষয়টি মোবাইলে স্বীকার করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা...।
নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়:
নজরুল স্মৃতিময় সেই বট তলায় ২০০৭ সালে গড়ে তুলা হয়েছে কবির নামে বিশ্ববিদ্যালয়, নাম- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। ত্রিশালের দরিরামপুর হাইস্কুল থেকে কাজীর শিমলা দারোগা বাড়ির দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। এই পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে হতো নজরুলকে স্কুলে ক্লাস করার জন্য। বর্ষাকালে রাস্তা চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ত। ফলে স্কুলে যাতায়াতে খুব কষ্ট হতো নজরুলের। এই অসুবিধা লাঘব করার জন্য দারোগা সাহেব ত্রিশালের নামাপাড়ায় তাঁর আত্মীয় কাজী হামিদুল্লাহর বাড়িতে জায়গীর রাখেন নজরুলকে। জায়গীর থাকার সময় এতো স্বাধীনতা ছিল না নজরূলের। তাই সে বাঁশি বাজানো, গান গাওয়া, রাস্তাঘাট, বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো, নামাপাড়ার শুকনিবিলের পাশের বট গাছে ওঠে বাঁশি বাজানো ইত্যাদি করতেন। আর এই বট গাছকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়। যে বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে আঁকড়ে ধরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট বিভাগ আছে ২৪টি । এই প্রতিটি বিভাগে বাধ্যতামূলক নজরুল স্টাডিজ নামে একটি কোর্স পড়ানো হয়। শুধু মাত্র নজরুল চেতনা শিক্ষার্থীদের মাঝখানে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য । বিশ্ববিদ্যালইয়ের নানা স্থাপনার নাম রাখা হয়েছে নজরুকে কেন্দ্র করেই । ‘চির উন্নত মম শির’ নামক স্মৃতিসৌধ আর ‘চক্রবাক’ নামক ক্যাফেটেরিয়া । বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি আবাসিক হলের নামও নজরুলের সৃষ্টিকর্মের নামে আগ্নিবীণা ও দোলনচাঁপা । ‘প্রভাতি’, ‘ঝিঙেফুল’, ‘বিদ্রোহী’ ও ‘প্রলয়শিখা’ বাসের নাম আর দুটি মঞ্চের নাম ‘চুরুলিয়া’, ‘গাহি সাম্যের গান’ আর পাশাপাশি একমাত্র মেডিকেল সেন্টারের নামও নজরুলের বইয়ের নামে ‘ব্যথার দান’। পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে নজরুলকেই স্মৃতি চারণ করা । বিশ্ববিদ্যালয়ও আয়োজন করেছে তিন দিন ব্যাপী নানান কর্মসূচী।
নজরুল ইন্সটিটিউট:
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠা করে হয়েছে “নজরুল ইন্সটিউট”। যেখানে নজরুলের সাহিত্য চর্চা এবং নজরুলের সাহিত্যকর্মের ওপরে গবেষণার করা হয়। নজরুল ইনস্টিটিউটের রয়েছে একটি সম্বৃদ্ধ লাইব্রেরি। এই ইন্সটিউট থেকে দেশ বিদেশে গবেষকদের নিয়ে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন সেমিনার।
নজরুল জয়ন্তী:
নজরুল আগমনকে এই অঞ্চলের মানুষ উৎসবমুখর ভাবে পালন করেন ১৯৬৫ সাল থেকে। ময়মনসিংহের তৎকালীন জেলা প্রশাসক পি.এ. নাজির এ বিদ্যালয় মাঠে জাঁকজমকপূর্ণ নজরুল জন্মজয়ন্তী পালন শুরু করে। ১৯৯০ সালে এ স্কুল মাঠে রাষ্ট্রীয়ভাবে জন্মজয়ন্তী পালন শুরু হয় এবং এখব পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। প্রতি বছর নজরুলের জন্মদিনে তিন দিন ব্যাপী আয়োজন করা হয় এই নজরুল জয়ন্তীর৷ আর নজরুল জয়ন্তীকে ঘিরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা অনুষ্ঠান এবং বিশাল মেলা জমে। যেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ছুটে আসে। আগামী ২৫, ২৬ ও ২৭ মে নজরুল জয়ন্তীকে ঘিরে উৎসবে আমেজ বিরাজ করছে। জেলা প্রশাসন ময়মনসিংহ তিন দিন ব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী অফিসারআব্দুল্লাহ আল বাকিউল বারী জানান, তিন দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানকে ঘিরে এরই মধ্যে সকল প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। জাতীয় ও স্থানীয় নজরুল শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করবেন।
0 Comments