ডিমেনসিয়া একটি মস্তিষ্ক ক্ষয়জনিত রোগ। এর প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। উন্নত ও অনুন্নত উভয় দেশেই এটি বাড়তির দিকে। আমরা যদি উন্নত দেশের কথা চিন্তা করি, তাহলে সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ ডিমেনসিয়াতে ভুগছে।
আরেকটু যেটি শঙ্কার বিষয়, দেখা যাচ্ছে, উন্নত দেশগুলোতে দুইজন নারী ডিমেনসিয়াতে ভুগছে। এমন অবস্থা আমরা অনুন্নত বা উন্নতিকামী দেশগুলোতে দেখি। বাংলাদেশের দিকে তাকালেও দেখা যাবে চারজনের মধ্যে তিনজনই নারী। এদের কীভাবে ঠিকমতো সেবা ও পরিচর্যা করা যায়, এদের জন্য একটি দেশ কীভাবে পলিসি করতে পারে, সেসব নিয়েই আজ কথা বলবো।
এর কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় রয়েছে। নন কমিউনিক্যাবল রোগগুলো ডিমেনসিয়া বা আলঝাইমারের ঝুঁকির কারণ। যেমন: উচ্চ রক্তচাপ বা হার্টের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা, কোলেস্টেরল বেশি থাকা, ডায়াবেটিস ইত্যাদি। এ ছাড়া যারা বিষণ্ণতায় ভুগে, মানসিক অবস্থা ভালো নেই, এমন নারী বা পুরুষরাও ডিমেনসিয়াতে ভুগতে পারে। আরেকটি দেখা যাচ্ছে, যারা বেশি স্থূল বা ওবেস তাদেরও এই সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
তাহলে ডিমেনসিয়া যেন কম হয় আমার, সেটির জন্য আমি কী করতে পারি? এই বিষয়গুলো আমরা একটু জেনে নিই। ব্যক্তিগতভাবে আমি কীভাবে সুরক্ষাটি আনতে পারি, সেটি নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
তাহলে বিষয়টি হলো, আমাদের যেন এই রোগগুলো না হয়। এই ক্ষেত্রে হার্ট ও মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হবে। ডায়াবেটিস থাকলে এটি ব্যবস্থাপনা করা জরুরি। এর জন্য যে সেবা, ওষুধ ও রুটিন দরকার, সেটি ব্যবস্থাপনা জরুরি।
আমরা জানি, তামাক পান করা, সিগারেট খাওয়া বা ব্যবহার করা ইত্যাদি বড় ধরনের ঝুঁকি। সুতরাং তামাক সেবনকে বাদ দিতে হবে। আর যেসব দেশের মানুষ মদ্যপান বেশি করে, তাদেরও বলা রয়েছে, তোমরা এটি বেশি খাবে না। আরেকটি পরামর্শ খুব দেওয়া হয়, মনকে প্রফুল্ল রাখতে হবে, যেন বিষন্নতায় না যায়। একা যেন না থাকে, সামাজিকভাবে যেন মানুষের সঙ্গে মেশে।
আরেকটি বিষয় আমরা সবাইকে বলে থাকি। সেটি হলো, শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকতে হবে; ব্যায়াম করতে হবে। দেহকে একটি ব্যায়ামের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি, খাবারের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। খাবারটি যেন ভারসাম্যপূর্ণ হয়।
খাওয়াটি এমন হবে না যে আপনাকে আরো স্থূল করবে; ডায়াবেটিস বাড়িয়ে দেবে। বেশি মাংস বা উচ্চ চর্বিজাতীয় খাবার খাবেন না। এতে দেহ আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রতিদিন সঠিক খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক চর্চা ও সুস্থ জীবনের মধ্যে থাকলে সেই মানুষটির ডিমেনসিয়া বাড়ার ঝুঁকি অনেক কমে।
আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কানে সঠিকভাবে শোনার বিষয়টি। আমরা অনেক সময় বুঝি না, কানে কম শুনতে পাচ্ছি। চিকিৎসক হিসেবে আমার পরামর্শ থাকবে চল্লিশের পরে আপনি কানে ঠিকঠাকমতো শুনতে পারছেন কি না, সেই পরীক্ষা করিয়ে নিন। একটি বেজ লাইন করুন। এরপর হয়তো তিন বা চার বছর পর পরীক্ষা করলেন। কেন এই পরীক্ষাটি জরুরি? কারণ, কানে না শুনতে পারলে আপনার মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করবে না, ডিমেনসিয়ায় ভুগবেন।
আর যারা খেলোয়ার রয়েছে, তারা যেন মস্তিষ্কে আঘাত না পায়। কারণ, মাথায় আঘাত ডিমেনসিয়ার জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি।
এবার আসি, যাদের ডিমেনসিয়া হয়ে গেছে, তাদের জন্য কী করতে হবে? তাদের জন্য যে সেবাটা দরকার, সেটা কেমন হবে? ব্যক্তিকে নিয়ে চিন্তা করলে, তার যে মানসিক অবস্থা, সেটা কেমন হচ্ছে বোঝা জরুরি। সে কি নিজে বাথরুমে যেতে পারছে না কি অসুবিধা হচ্ছে, খেয়াল করতে হবে। দেখতে হবে নিজে নিজে প্রস্রাব করতে পারছে কি না, গোসল করতে পারছি কি না, শোবার ঘর ও বাথরুম চিনতে পারছে কি না। এমনও অবস্থা হয়ে যায় কোনদিকে বাথরুম সেটা হয়তো চিনছে না। খেতে দেওয়া হলে হয়তো চামচ বা হাত কিছু দিয়েই খেতে পারছে না।
সুতরাং একজন ডিমেনসিয়া রোগীর অবস্থার ওপর নির্ভর করে তার যত্ন দিতে হবে। এমনও হতে পারে, তাকে বাথুরুমে ধরে নিয়ে যেতে হচ্ছে। বাথরুমের জন্য তাকে চেয়ার বিছানার কাছে দিয়ে দিতে হতে পারে। এসব বিষয় বুঝে পরিবারের মানুষকে কাজের ভাগাভাগি করে সেবাটা দিতে হবে।
অনেক জায়গায় দেখা যায়, এসব রোগী নির্যাতনের শিকার হয়ে যায়। অনেক রোগী রয়েছে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে চায়, রাস্তায় চলে যাবে। তখন তাকে রাস্তায় যেতে দেওয়া যাবে না। দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সে ফিরে এসে বাড়ি খুঁজে পাবে না। সে বাড়ি না খুঁজে পেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে। ডিমেনসিয়ার এমনও অনেক বড় বড় লক্ষণ রয়েছে। সুতরাং তাকে আসলে সুরক্ষা দিতে হবে, সেবা দিতে হবে। তার যে সেবা, খাদ্য, আবহাওয়া দরকার সেটি দেওয়া জরুরি।
আমাদের স্বাস্থ্যসেবায় যারা নিয়োজিত রয়েছে, ডাক্তার থেকে শুরু করে প্যারামেডিক যারা রয়েছে, এদের সবাইকে ডিমেনসিয়া সম্পর্কে জানাতে হবে। ডিমেনসিয়ার যত্নের ধরনটা জানা জরুরি। এই রোগের কী কী লক্ষণ হতে পারে, পরিবারের মানুষকে কীভাবে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে, তা জেনে রাখতে হবে।
আমরা অনেক সময় দেখি, রোগী চিকিৎসকের কাছে গেলো, উনি ২০টি ওষুধ দিয়ে দিলেন। ডিমেনসিয়া রোগী ঐ ২০টি ওষুধ কীভাবে খাবে এবং তার সত্যি সত্যি কোনো উপকার হবে কি না, এটি আমাদের একটি আদর্শগত বিষয়। আমি তাকে কী ওষুধ দিচ্ছি, কতটুকু ওষুধ দিচ্ছি, সেগুলো তার কোনো উপকারে আসবে কি না, সেগুলো বুঝতে হবে।
পরিবার তো এমনিতেই বিধ্বস্ত। এরপরও ১৫ থেকে ২০টি ওষুধ কিনতে দিলে অর্থনৈতিকভাবে আরো বিব্ধস্ত হয়ে যাবে। তাহলে সেই পরিবারটির কথা চিন্তা করতে হবে। রোগীকে সেই ওষুধই দিতে হবে যার খরচ সে বহন করতে পারে এবং যেটি তাকে সুস্থ থাকতে সহায়তা করে।
ডিমেনসিয়াকে একই পর্যায়ে রাখতে পারা গেলে ভালো। একেই আমরা অনেক সৌভাগ্যের মনে করি। আমরা ইতিহাস থেকে জেনেছি ডিমেনসিয়াকে সম্পূর্ণ ভালো করা যায় না। ক্ষতিকে কমিয়ে নিয়ে আসা যায়। কিছু ওষুধ রয়েছে যা কি না সহায়ক হতে পারে। সুতরাং খুব বুঝেশুনে তাকে চিকিৎসা দিতে হবে; পরীক্ষা করতে হবে। কেবল যতটুকু পরীক্ষা না করলে নয়, ততটুকু করা ভালো। রোগীর পকেট থেকে যেন অনেক টাকা খরচ না হয়, সেই জিনিসটিও যারা সেবাদানকারী তারা বিচার বিবেচনা করতে পারে।
অনেক বাড়িতে ক্যানসার সারভাইভার, প্রতিবন্ধী বা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত মানুষ থাকে। এই ধরনের মানুষকে যারা সেবা দেয়, তাদের কমিউনিটিতেও ডিমেনসিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে জানাতে পারলে ভালো। তাদের সেবার আওতায় আমরা ডিমেনসিয়ার রোগী আনতে পারলে, আমাদের ভার অনেকদিক থেকে কমে আসে।
আমাদের সরকারের কাছে যেটি আবেদন এবং আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি, সেটি হলো, ডিমেনসিয়ার জন্য বিশেষায়িত সেন্টার রাখা। এখানে চিকিৎসকরা এটি সম্পর্কে জানবে, রোগীরা সেবা পাবে। সেখান থেকে অন্যান্য চিকিৎসকদেরও আমরা আরো প্রশিক্ষণ দিতে পারবো। যারা পরে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করবে। আমাদের আরেকটি বিষয় দরকার। সেটি হলো, তথ্য বা ডেটা। এটি না থাকলে যারা নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে বসে রয়েছেন, তাদের আমরা তথ্য দিতে পারবো না।
আজ যেমন আমরা বলছি, ডিমেনসিয়ায় আক্রান্তদের চারজনের মধ্যে তিনজনই নারী। এটি আসলো কোথা থেকে? যেহেতু আমরা গবেষণা করেছি এবং গবেষণালব্ধ ফলাফল পেয়েছি, সেহেতু আমরা জেনে নিয়ে এর ওপর ব্যবস্থাপনাটা পরিচালনা করবো। আমার মনে হয়, আমাদের দেশে ডিমেনসিয়ার ওপর পলিসি থাকা প্রয়োজন, বিশেষায়িত সেন্টার থাকা প্রয়োজন এবং প্রত্যেক স্বাস্থ্যকর্মীর এই ডিমেনসিয়া সম্পর্কে জ্ঞান থাকা উচিত। পাশাপাশি তারা পরিবারকে কীভাবে ব্যবস্থাপনা করবে, এই রোগীকে কীভাবে ব্যবস্থাপনা করবে, এই বিষয়ে জ্ঞান থাকলে তারা ঐ পরিবারের মানুষকে পরামর্শ দিতে পারবে।
আমাদের দেশে একটি স্টিগমা রয়েছে। এই ধরনের রোগীকে মানুষ পাগল বলছে। এরা পাগল নয়। এরা একটি অসুস্থ মানুষ, যার সুস্থতা দরকার এবং সুস্থ থাকতে সেবা দরকার। এটা আমাদের দায়িত্ব। অনেক দেশ রয়েছে এই বিষয়ে বিশেষ ইনসুরেন্স রয়েছে। অনেক দেশ রয়েছে, যেখানে বৃদ্ধ বয়সে তাকে আলাদা করে অর্থ উপর্জন করতে হয় না, তার যে ইনসুরেন্স রয়েছে, সেটা দিয়ে সেবাটা হয়ে আসে। আমাদের দেশে এই ধরনের রোগের জন্য ইনসুরেন্স করলে বৃদ্ধ বয়সে টাকার অভাবে বেশি ভুগতে হবে না। তারা একটি ব্যবস্থার মধ্যে চলে আসবে।
সুতরাং সরকার, পলিসি মেকার ও সিনিয়র প্রোগরাম ম্যানেজারদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাচ্ছি, এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের যেন বেশি ভুগতে না হয়। তারা যেন সঠিক চিকিৎসাব্যবস্থা, সেবা ও সম্মানটি পায়। তাহলে এই রোগে আক্রান্তদের আমরা নিরাপদে রাখতে পারবো।
লেখক: রোকেয়া পদকে ভূষিত বিশিষ্ট নারী ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
0 Comments