বাংলাদেশে শিল্প-কারখানা বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশ লাভ ঘটেছে দৃশ্যমান পর্যায়ে। সময়ের আবর্তে গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশ ঘটায় তা আজ বিশ্ব সমাদৃত ও পরিচিত। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অজর্নের শীর্ষ খাত বর্তমানে গার্মেন্টস শিল্প। দিন দিন গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশ ঘটায় বিপুল সংখ্যক শ্রমিক এই শিল্পে কর্মরত। বর্তমানে অর্ধকোটির উপরে শ্রমিক কর্মরত রয়েছে।
এই যে অর্ধকোটিরও বেশি শ্রমিক গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত তাদের কর্মক্ষেত্র কতটুকু নিরাপদ সে প্রশ্নটি আমাদের মনে জেগে উঠে বিভিন্ন নির্মম চিত্রের কারণে। সর্বশেষ, গত ১৪ অক্টোবর ২০২৫ ঢাকার মিরপুরের রূপনগরে আনোয়ারা ফ্যাশন নামক গার্মেন্টসে অগ্নিকান্ডে ঐদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৬ জন অসহায় শ্রমিক নিহত হয়েছে। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। অনেকেই নিখোঁজ বলে জানিয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যগণ (BBC News বাংলা, ১৫ অক্টোবর ২০২৫)।
আমরা দেখছি বিভিন্ন সময়ে গার্মেন্টসে অগ্নিকান্ড ঘটছে। পরবর্তীতে প্রচারমাধ্যমে তথ্য প্রকাশিত হয়। দেখা যায়, অগ্নিকাণ্ডের শিকার বেশিরভাগ কারখানায় মালিকপক্ষ কর্তৃক শ্রমিকদের জন্য যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়নি। যার কারণে অগ্নিকাণ্ড বা অন্য কোন দূর্ঘটনা ঘটলে প্রয়োজনীয় বহির্গমন ব্যবস্থা অপ্রতুল থাকায় হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটছে। অগ্নিকান্ডের সময় এই আনোয়ারা ফ্যাশনের ভবনের ছাদের দরজাও তালাবদ্ধ ছিল। এ কারণে শ্রমিকেরা কেউ ভবনের ছাদে উঠতে পারেননি। হতাহতের সংখ্যা বেশি হওয়ার এটিও একটি বড় কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। ছাদের প্রবেশের দরজা তালাবদ্ধ থাকায় কেউ ছাদে যেতে পারেনি। রাসায়নিক বিষাক্ত ধোঁয়ায় শ্রমিকরা অজ্ঞান হয়ে য়ায়। ঢলে পড়ে মৃত্যুরকূলে!
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠ আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনস গার্মেন্টসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। কয়েক ঘণ্টা আগুনে আটকে থাকে কর্মরত শ্রমিকেরা। মারা যায় ১১৪ জন। আহত অগণিত। আহত অনেকেই পরবর্তীতে পঙ্গুত্ববরণ করে। আগুন লাগার পরে ফ্লোরের গেটে তালা লাগিয়ে দেওয়ায় বের হতে পারেনি শ্রমিকেরা। সারাবিশ্ব সেদিন দেখেছে আগুনের লেলিহান শিখা এবং পুড়ে ছাই হওয়া নিহত ও আহত শ্রমিকের দেহ। ছিল এক নির্মম হত্যাকান্ড! আজ পর্যন্ত কি এই হত্যাকান্ডের দায়ীদের বিচার হয়েছে। হয়নি। বিচার প্রক্রিয়া মন্থর হওয়ায় ঝুলে রয়েছে বিচার কার্যক্রম। বরং প্রকারান্তে রাজনৈতিক বলয়ে আশ্রয় দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। তাজরীনের মালিক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনকে পরবর্তিতে মৎস্যজীবি লীগের ঢাকা উত্তরের সভাপতি করা হয় (প্রথম আলো, ১৭ মে ২০২২)। অর্থাৎ আলোচিত হত্যাকান্ডের দায়ী ব্যক্তি হলেও দেলোয়ার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বলয়ে থেকেছে।
তাজরীন গার্মেন্টসের হত্যাকান্ডের ঘটনার আগে পরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গার্মেন্টসে বহু অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। কর্মরত শ্রমিকরা নিহত ও আহত হয়েছে। কিন্তু কোনটারই বিচার হয়নি। কোন দায়ী মালিকের কেশাগ্র পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারেনি রাষ্ট্রযন্ত্র। করেওনি হয়তো ইচ্ছা করে। কারণ, রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রিত মালিকশ্রেণী দ্বারা। হয়তো আনোয়ারা ফ্যাশনের মালিকও পার পেয়ে যাবে। অতীতে অন্য মালিকরা যেমন পার পেয়েছে।
প্রশ্ন হলো, যুগে যুগে এদেশে শ্রমিকরা কি পুড়তেই থাকবে? আমরা সাধারণ নাগরিকরা তো এমন গার্মেন্টস কারখানা চাই না, যে কারখানার কর্মক্ষেত্র নিরাপদ নয়। আইন অনুয়ায়ী, যে গার্মেন্টস কারখানায় কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের জীবন নিরাপদ নয় সে গার্মেন্টস কারখানার দরকার নাই। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন পরে, আগে দরকার শ্রমিকের নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নিশ্চিতকরণ। একশ্রেণীর অর্থলোভীর কারণের ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠেছে গার্মেন্টস কারখানা যথাযথ নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত না করেই। ফলে একের পর এক ঘটছে নির্মম মৃত্যুর ঘটনা, যা হত্যাকান্ড বলে আমরা মনে করি।
আশ্চর্যজনক ও নির্মম সত্য হলো, আজ পর্যন্ত গার্মেন্টস কারখানাকেন্দ্রিক অগ্নিকান্ডে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় কোন মালিকের যথাযথ শাস্তি হয়নি। বিচার প্রক্রিয়ার বেড়াজালে ও রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় দায়ী মালিক পার পেয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রযন্ত্র যেন মালিকের, শ্রমিকের নয়। তাই তো শ্রমিক পুড়ছে! শ্রমিক যেন পুড়বেই!
লেখক পরিচিতি: সভাপতি, সমাজ রূপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘ, ময়মনসিংহ
0 Comments