প্রতিদিন চরকা

প্রতিদিন চরকা

সাংস্কৃতিক সংগঠনের স্বরুপ কেমন হওয়া উচিত? -ইমতিয়াজ আহমেদ



সংস্কৃতি হলো একটি জাতির সামগ্রিক জীবনাচার, রীতিনীতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, চিন্তাচেতনা, নিজস্ব ইতিহাসের বহি:প্রকাশ। এই সংস্কৃতিই জাতিগঠনের অন্যতম মাধ্যম। সংস্কৃতির মাধ্যমেই ফুটে উঠে একটি জাতির মানসিক প্রকাশ। যে জাতি সংস্কৃতিগতভাবে যত উন্নত সে জাতির মানসিক বিকাশও তত উন্নত। এই সংস্কৃতিই আবার গড়ে তোলে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। সচেতন সাংস্কৃতিককর্মীরা জাগিয়ে তুলে জাতিকে। অতীতে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ বিভিন্ন লড়াই সংগ্রামে সাংস্কৃতিক কর্মীদের সরব উপস্থিতি এর চাক্ষুষ প্রমাণ। বর্তমানেও সচেতন গণমূখী সাংস্কৃতিক কর্মীরা রাজপথে সরব হয়। অন্যায় অপরাধ, সমাজ, জাতি ধ্বংসকারী অপচক্রের অপকর্মের বিরুদ্ধে রাজপথে প্রতিবাদমূখর হয়। জাগিয়ে তোলার প্রয়াস চালায় গণমানুষকে। গণমানুষকে অপচক্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানায়। ডাক দেয় প্রতিরোধের। দাবী তোলে সরকারের নিকট। মানবিকতার উত্তম প্রকাশ ঘটিয়ে সচেতন সাংস্কৃতিক কর্মীরা অসহায়, নির্যাতিত  মানুষের পাশে দাঁড়ায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ দুর্বিপাকে ছুটে চলে প্রান্তর থেকে প্রান্তরে। তোলে ধরে মানবতার মানবিক পতাকা।

স্বজাতীয় সংস্কৃতিকে সাংগঠনিকভাবে বিভিন্ন আবহে আঙ্গিকে তোলে ধরে সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ। প্রশ্ন হলো, একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের স্বরুপ কেমন হওয়া উচিত? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মাঝে নিহিত রয়েছে সাংস্কৃতিক সংগঠনের স্বরুপের চিত্র। তাই এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা অতীব জরুরি। 

সাংস্কৃতিক সংগঠনকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক লেজুড়ভিত্তিক বৃত্ত থেকে দূরে থাকা একান্ত প্রয়োজন। তা নাহলে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনে স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্রবোধ থাকে না। থাকে লেজুড়ভিত্তিক মানসিকতা। লেজুড়ভিত্তিক মানসিকতার কারণে চাওয়া পাওয়ার নদীতে ডুব দেয়। করে বেড়ায় তোষামোদি। ফলে জড়িয়ে যায় নেতিবাচক কর্মে। অতীতে আমরা এমনটি দেখেছি, বর্তমানেও দেখছি। স্বকীয়তা বজায় রাখার লক্ষ্যে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি থেকে দূরে থাকা একান্ত বাঞ্চনীয়। 

অতীতে দেখা গিয়েছে, সংস্কৃতির নামে বিভিন্ন সংগঠন বা ব্যক্তি কর্তৃক ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল ও নেতার লেজুড়বৃত্তি বা তোষামোদি করতে। এতে সাংস্কৃতিক অঙ্গন চরমভাবে কলুষিত হয়েছে। লেজুড়বৃত্তি  বা তোষামোদের কারণে সংস্কৃতি অঙ্গনে বিভেদ রেখা সৃষ্টি হয়েছে। যা ব্যাহত করছে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে। এতে সংস্কৃতির বিকাশ না ঘটে দৃশ্যমান হয়েছে সংস্কৃতির সংকোচন চিত্র। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বাদ দিয়ে কে কাকে কিভাবে ঘায়েল করতে পারে সে অপচেষ্টায় লিপ্ত থেকেছে। বর্তমানেও সংস্কৃতি অঙ্গনে এহেন নেতিবাচক চিত্র দৃশ্যমান। সংস্কৃতির বৃহত্তর স্বার্থে নেতিবাচক কর্ম থেকে বিরত থাকা প্রতিটি সাংস্কৃতিক সংগঠন, সংগঠক/কর্মির একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য।

এদিকে কোন কোন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে সাংস্কৃতিক সংগঠন বা জোট রয়েছে। এ ধরণের সাংস্কৃতিক সংগঠন বা জোটের ক্ষেত্রে স্বকীয়তা বজায় রাখা সম্ভব নয় তা স্বাভাবিকভাবেই প্রতীয়মান। কারণ,  সাংস্কৃতিক অঙ্গ সংগঠন নিজ রাজনৈতিক দলের স্বার্থ সংশিষ্ট বিষয়ে এবং নিজেদের স্বার্থে  লিপ্ত থাকবে এটা স্বাভাবিক।  এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক সংগঠনের করণীয় কি? এ প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। স্বতন্র সাংস্কৃতিক সংগঠনের করণীয় হলো, রাজনৈতিক অঙ্গ সংগঠন হিসেবে পরিচিত সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে সাংগঠনিক দূরত্ব বজায় রাখা। দূরত্ব বজায় না রাখলে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক সংগঠনের স্বকীয়তা ক্ষুন্ন হওয়ার অবকাশ থেকে যায়।

গণমানুষ সংস্কৃতির সহজাত ও সার্বজনীন ধারক বাহক। তাই হলরুমকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যথাসম্ভব  পরিহার করে বা কমিয়ে এনে উন্মুক্ত স্থানে গণমানুষের  মাঝে আয়োজন করা উচিত। এর ফলে সংস্কৃতির  বিকাশ এবং গণমানুষের সাথে সংস্কৃতির মেলবন্ধন উত্তরোত্তর দৃঢ় হবে। চার দেয়ালের মাঝে সংস্কৃতিকে আবদ্ধ করলে সংস্কৃতি গণমানুষ থেকে বিছিন্ন হয়ে যায়। এতে সংস্কৃতির বিকাশ না ঘটে প্রকারান্তে সংকোচিত হয়।

সংস্কৃতির নামে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিকে বিভিন্নভাবে অস্বাভাবিক অর্থ কামানোর লিপ্সায় লিপ্ত থাকতে দেখা যায়। এই লিপ্সার কারণে কখনো কখনো নেতিবাচক কর্মের সাথে জড়িয়ে  যায়। অস্বাভাবিক অর্থের পিছু ছুটা সাংস্কৃতিক সংগঠন বা কর্মির কাজ নয়। জাতির অগ্রসর অংশ হিসেবে সাংস্কৃতিক সংগঠন বা কর্মির কাজ হলো ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতিকে তোলে ধরা। এই দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থেকে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা একান্ত জরুরী। যেনতেনভাবে অস্বাভাবিক অর্থের পিছু ছুটে বিনোদন কর্মিরা, সাংস্কৃতিক কর্মিরা নয়। সাংস্কৃতিক কর্মি ব্যক্তি জীবনের বাইরে নাগরিক দায়িত্ব পালন করে। সাংস্কৃতিক সংগঠন ও কর্মিদেরকে এ বিষয়টি অনুধাবন করা একান্ত জরুরি। নিয়মতান্ত্রিকভাবে উপার্জিত বা সংগৃহীত বা প্রাপ্ত স্বাভাবিক অর্থের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করাই শ্রেয়।

ব্যক্তিবিশেষকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন সংগঠন সাংস্কৃতিক আয়োজন বা কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। সাংস্কৃতিক আয়োজনে প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি, মূখ্য আলোচক ইত্যাদি উল্লেখ করে বিভিন্ন ব্যক্তিকে দাওয়াত দিয়ে তোয়াজ তরিকা অনুসরণ করা হয়। ব্যক্তিবিশেষকে প্রাধান্য না দিয়ে গণমানুষকে প্রাধান্য দিয়ে সাংস্কৃতিক আয়োজন বা কর্মকান্ড পরিচালনা করা যথাযথ। কারণ, সংস্কৃতি সহজাত ও সার্বজনীন, যা ধারণ লালন করেন সকল শ্রেণীপেশার মানুষ তথা গণমানুষ। তাই ব্যক্তিবিশেষ তোয়াজ তরিকা অনুসরন করা থেকে বিরত থাকা বাঞ্চনীয়। অনুষ্ঠান আয়োজন বা কর্মকান্ড হতে হবে বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে কোন ব্যক্তিবিশেষকে  প্রাধান্য দিয়ে নয়।

সাংস্কৃতিক সংগঠনের স্বরুপের উপর নির্ভর করে তার কর্মপরিধি বা কর্মরুপ বা কর্মের ধরণ। একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনে থাকা উচিত স্বকীয়তা, স্বচ্ছতা, স্বাতন্ত্রবোধ ও সার্বজনিনতা।। যদি সাংস্কৃতিক সংগঠনে স্বকীয়তা, স্বচ্ছতা, স্বাতন্ত্রবোধ ও সার্বজনিনতা থাকে তাহলে সে সংগঠন স্বাধীনভাবে নিজস্ব চিন্তাভাবনায় বলিয়ান হয়ে দৃঢ়চিত্তে কাজ করার শক্তি পায়। প্রণয়ন করতে পারে কাজের কর্মপরিকল্পনা। কারোর মুখাপেক্ষী না হয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কাজেই, স্বতন্ত্র প্রতিটি সাংস্কৃতিক সংগঠনে থাকুক লেজুড়ভিত্তিবিহীন স্বকীয়তা, স্বচ্ছতা, স্বাতন্ত্রবোধ ও সার্বজনিনতা। 

লেখক পরিচিতি: সভাপতি, সমাজ রূপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘ, ময়মনসিংহ
 

Post a Comment

0 Comments