ইতিহাস সবসময় লেখা হয় শক্তিশালীদের কলমে। যে রাজা যুদ্ধে জিতেছে ছলে বলে,কৌশলে, অত্যাচার,নির্যাতন এর মধ্য দিয়ে যে ভাবেই হউক না কেন
সেই হয়েছে বীর।তার লোকেরা তার গুণকীর্তন করে লেখে ইতিহাস। যে রাজা হেরেছে সে পরিনত হয়েছে দেশদ্রোহী বা অযোগ্য। তাদের ইতিহাস কেউ লেখে না।
আমাদের এই বাংলায় আর্য,মৌর্য, গুপ্ত, পাল,সেন, তুর্কী, মুঘলদের ন্যায় ইরেজরাও এসেছিল।ছলেবলে, কৌশলে তারা আমাদের পদানত করেছে। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে তারা হয়েছে শক্তিশালী ও ইতিহাস রচয়িতা। আমাদের দেশপ্রেমিকরা স্বদেশ স্বজাতীর মুক্তি ও কল্যাণের জন্য লড়াই করলেও বিশ্বাসঘাতকতা ও তাদের কুট-কৌশলের কাছে হেরেছে। যেহেতু তাঁরা জয়ী হতে পারেনি ফলে তাঁদের কন্ঠ রুদ্ধ, তাঁদের কথা কেউ শোনে নাই,কেউ লিখে নাই। তবে ইতিহাসে তাঁদের নাম লেখা হউক আর নাই হউক তাঁরা অন্যায়,অত্যাচার,শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে ও দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে বিদ্রোহ চালিয়ে গেছে। এমন একটি বিদ্রোহ ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ।
যে কোন বিদ্রোহ নানা অর্থবহ। আর সেই অর্থ প্রেক্ষিতেই বোঝা যায়। প্রেক্ষিত কখনোই একমাত্রিক নয়, বরং বহুমাত্রিক। অর্থনীতি থেকে সংস্কৃতি, গোষ্ঠী থেকে ব্যক্তি ও শ্রেণি, নানা মাত্রায় বিদ্রোহ।
বাংলার ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ যা পরবর্তীতে পাগলপন্থী কৃষক বিদ্রোহ তা ছিল একটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ও তাদের দোসর জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ। এতে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁরা ইতিহাস এর ধারধারেনি তাঁরা ছিলেন দেশপ্রেমিক। আমাদের হৃদয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছেন তাঁরা হলেন:-
* শাহ্ সুলতান হাসান সুরিয়া বুরহানা:-
ফকির বিদ্রোহের মূল নেতা ছিলেন ফকির মজনু শাহ। তবে ফকির সন্ন্যাসী আন্দোলনের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছিল শাহ সুলতান হাসান সুরিয়া বুরহানার হাত ধরে। সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে তাঁর নেতৃত্বে মাদারিয়া তরিকার সুফি দরবেশরা বাংলায় এই আন্দোলন শুরু করেন। ১৭৬০ সালে পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলায় সন্ন্যাসীরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ শুরু করে। ১৭৬৩ সালে ফকির সন্ন্যাসীরা ঢাকার ইংরেজ কুটিতে প্রথম আক্রমণ করে। ১৭৬৪ সালে নবাব মীর কাশিম ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে ফকির সন্ন্যাসীদের সাহায্য চান। ফলে বক্সারের যুদ্ধে ফকির সন্ন্যাসীরা নবাবের পক্ষে যুদ্ধ করে।
* ফকির মজনু শাহ
* ভবানী পাঠক
* দেবী চৌধুরানী
বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মীর কাশিম পালিয়ে গেলেও ফকির সন্ন্যাসীরা তাদের ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। শাহ সুলতান হাসান সুরিয়া বুরহানার স্থলাভিষিক্ত হন ফকির মজনু শাহ। তিনি উত্তর বাংলার ইংরেজ বিরোধী তৎপরতা জোরদার করেন। ১৭৭১ থেকে ১৭৮৬ সাল পর্যন্ত তার নেতৃত্বে রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহ জেলায় ইংরেজদের সাথে বহু সংঘর্ষ হয়। ফকির মজনু শাহ বগুড়া থেকে ৫০০ সৈন্যের একটি দল নিয়ে পূর্বদিকে ময়মনসিংহে আসার পথে কালিশ্বর নামক স্থানে ইংরেজদের সাথে এক সম্মুখ সমরে গুরুতর আহত হন। তাঁকে ভারতের মাকনপুরে গোপন আস্থানায় নেওয়া হয়। ১৭৮৭ সালে তিনি সেখানে বিনাচিকিৎসায় মারা যান। ১৭৮৭ সালে লেফন্টেন্যান্ট ব্রেনানের নেতৃত্বে একদল ইংরেজ সৈন্যের আক্রমণে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নেতা ভবানী পাঠক তার দুই সহকারী সহ নিহত হন।
* মুসা শাহ
* চেরাগ আলী শাহ
* করিম শাহ
ফকির মজনু শাহের সহযোদ্ধা ছিলেন মুসা শাহ, পরাগল শাহ, সোবান শাহ, চেরাগ আলী শাহ, করিম শাহ, মাদার বক্স প্রমুখ ফকির নেতা। ফকির মজনু শাহের মৃত্যুর পর বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন মুসা শাহ। আভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের হিসেবে প্রথমে মুসা শাহ পরে পরাগল শাহ নিহত হন। ফলে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন করিম শাহ ও সোবান শাহ। করিম শাহ বা করম শাহের ইংরেজ ও অত্যাচারি জমিদার বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে জর্জ মরিসন তার ১১৭ পৃষ্ঠার রিপোর্টে তাঁকে পাগল নেতা (Mad revoletor) এবং তার বিদ্রোহকে পাগলপন্থী বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করেন। ১৮১৩ সালে করম শাহ পাগলপন্থী ফকির ১০৩ বছর বয়সে নিজ বাড়ি লেটির কান্দায় (নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলার ঘাঘড়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম) মৃত্যু বরণ করেন।
* ছফ্যাতি শাহ পাগলপন্থী ফকির
* টিপু শাহ পাগলপন্থী ফকির
ছফ্যাতিশাহ পিতা করম শাহের মৃত্যুর কিছুদিন পরই যোগীর গুহায় (নেত্রকোণা জেলার পূর্বধলা উপজেলার বৈরাটী ইউনিয়ন এর একটি গ্রাম) মারা যান। টিপু শাহ পাগলপন্থী ফকির এর নেতৃত্বে শেরপুরের গড় জরিপায় রাজধানী স্থাপন করে পাগলপন্থীদের স্বাধীন রাজ্যের শাসন কার্য চলতে থাকে। টিপু শাহের এই স্বাধীন রাজত্ব ১৮২৫ খ্রি. থেকে ১৮২৭ খ্রি. পর্যন্ত চালু ছিল।
* গুমানু সরকার
* উজির সরকার
* কৃষ্ণকান্ত আচার্য
টিপু শাহ পাগলপন্থী ফকির এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন রাজ্যের শাসন ব্যবসস্থার অন্যতম আমলা ছিলেন গুমানু সরকার। উচ্চকোটির বুদ্ধিজীবির লেখা লুপ্ত কবিতার অংশে টিপুর রাজত্বের একটি চিত্র পাই:-
“বকসু আদালত করে দীপচান ফৌজদার।
কালেকটরের সরবরাকার গুমানু সরকার
নহরদ্দি সরকার ও জরিপ পাগল সহকারী ফৌজদার”
সারাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন মানিয়া লইলেও ব্রহ্মপুত্রের উত্তরে পাগলপন্থী কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্বদানকারী পাগলপন্থী নেতা ও তাঁদের অনুসারীরা ইংরেজদের অধীনতা স্বীকার করে নাই। ইংরেজ সেনাপতি কর্ণেল ইয়ং হাজব্রান্ড ক্রমাগত ৮টি যুদ্ধে গুমানু সরকার ও তার বিশ্বস্ত উজির সরকারের কাছে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কলকাতা ও মাদ্রাজ দুর্গ থেকে অধিক সংখ্যক সৈন্য এনে শেরপুর অবরোধ করলে গুমানু সরকারের বিশ্বস্ত সেনাপতি জানকুরাম পলায়ণ করে। ফলে গুমানু সরকার তার বিশ্বস্ত উজির সরকার খোদাবক্স স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করতে করতে যুদ্ধ ক্ষেত্রেই শাহাদাত বরণ করেন।
* জানকু পাথর
* দোবরাজ পাথর
১৮৩৩ সালের এপ্রিল মাসে জানকু পাথর ও দোবরাজ পাথর একযোগে শেরপুর আক্রমণ করে। তারা থানায় আগুন ধরিয়ে দেয়। শেরপুরে কোম্পানীর দুরবস্থার খবর পেয়ে মে মাসে জামালপুর সেনানিবাস থেকে সেনাদল শেরপুরে পৌঁছায়। সেনাবাহিনী দু’ভাগ বিভক্ত হয়ে একদল ক্যাপ্টেন সিলের নেতৃত্বে আর একদল লেফটেনেন্ট ইয়ং হ্যাজবন্ড এর নেতৃত্বে অগ্রসর হলে জানকু পাথর ও দোবরাজ পাথরের বাহিনী কোম্পানী সরকারের সৈন্যদের কাছে হারতে আরম্ভ করে। ১৮৩৩ সালের ৩১ মে শেরপুর ও সুসঙ্গ পরগণায় বিদ্রোহ সাময়িকভাবে প্রশমিত হয়েছিল।
সীমিত গন্ডিতে সীমিত ভূ ভাগে সীমিত শক্তিতে জমিদার ও ইংরেজদের মহাপ্রতাপ ও শক্তির সামনে চুড়ান্ত পরিণামের কথা জেনেও নির্ভীক চেতানায় লড়াই করেছে। এই স্বাধীনতাকামী মানবদরদী দেশপ্রেমিক বীরপুরুষদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।
তথ্য সূত্র: * নেত্রকোণা জেলার ইতিহাস - আলী আহাম্মদ খান আইয়োব।
* ইমান ও নিশান (বাংলার কৃষক চৈতন্যের এক অধ্যায়) - গৌতম ভদ্র।
* ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ময়মনসিংহের বিবরণ - শ্রী কেদারনাথ মজুমদার।
* বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্ব সভ্যতা - নবম ও দশম শ্রেণি - জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ

0 Comments