বাঙালীর জীবনে 'ভেজাল' শব্দটি অতিমাত্রার পরিচিত শব্দ। কারণ, কারণ খাদ্যদ্রব্যসহ প্রায় প্রতিটি দ্রব্যেই ভেজাল। ভেজাল খাদ্যদ্রব্যে সযলাভ হয়ে পড়েছে পুরো দেশ। শঙ্কাগ্রস্থ ক্রেতা সাধারণ। টাকা দিয়ে কিনছে বিষময় ভেজাল খাদ্য । দিনদিন ভেজালের জালে বন্দী হয়ে পড়েছে ক্রেতা সাধারণ।
নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ এর ধারা ২(১৭)'তে ‘‘নিরাপদ খাদ্য’’ বলতে প্রত্যাশিত ব্যবহার ও উপযোগিতা অনুযায়ী মানুষের জন্য বিশুদ্ধ ও স্বাস্থ্যসম্মত আহার্য খাদ্যকে বুঝানো হয়েছে। নিরাপদ খাদ্যের এই বর্ণনা অনুযায়ী ক্রেতারা কাংখিত খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতে পারছে কি? ভেজালের জালে আটকা পড়ে তারা কি অর্থ দিয়ে বিষ ক্রয় করছে না? প্রতিনিয়ত একশ্রেণীর অতিলোভী মুনাফাখোর ব্যবসায়ী বিবেক বর্জিতভাবে খাদ্যে ভেজাল মেশাচ্ছে। তাদের কাছে অর্থ কামানোটাই যেন মূখ্য। তা যে কোনভাবেই হোক। ভেজাল খাদ্যদ্রব্যে ক্রেতার জীবনহানির কারণ হলেও তাতে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ভেজাল খাদ্য আজ আমাদের সামনে নীরব ঘাতক হিসেবে উপস্থিত হয়েছে।
নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ এর ধারা ২৫-এ বলা হয়েছে, "কোন ব্যক্তি বা তাহার পক্ষে নিয়োজিত অন্য কোন ব্যক্তি, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, কোন ভেজাল খাদ্য বা খাদ্যোপকরণ বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে উৎপাদন অথবা আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুদ, সরবরাহ বা বিক্রয় করিতে পারিবেন না।" কিন্তু নিরাপদ খাদ্য আইনের এই নির্দেশনা অসাধু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা মানছেনা। বেপরোয়াভাবে খাদ্যে ভেজাল মিশাচ্ছে। এদের কারণে মানুষের জীবন আজ হুমকির মুখে। ভেজাল খাদ্য খেয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন রোগে।
নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ এর ধারা ২(২৯)'তে বলা হয়েছে ‘‘ভেজাল খাদ্য’’ অর্থ এমন কোন খাদ্য বা খাদ্যদ্রব্যের অংশ,(ক) যাহাকে রঞ্জিত, স্বাদ-গন্ধযুক্ত, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ বা আকর্ষণীয় করিবার জন্য এইরূপ পরিমাণ উপাদান দ্বারা মিশ্রিত করা হইয়াছে, যে পরিমাণ উপাদান মিশ্রিত করা মানব-স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং যাহা কোন আইনের অধীন নিষিদ্ধ; বা (খ) যাহাকে রঞ্জিতকরণ, আবরণ প্রদান বা আকার পরিবর্তন করিবার জন্য এমন কোন উপাদান মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে মিশ্রিত করা হইয়াছে যাহার ফলে মূল খাদ্যদ্রব্যের ক্ষতি সাধিত হইয়াছে এবং যাহার ফলে উহার গুণাগুণ বা পুষ্টিমান হ্রাস পাইয়াছে; বা (গ) যাহার মধ্য হইতে কোন স্বাভাবিক উপাদানকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে অপসারণপূর্বক অপেক্ষাকৃত স্বল্প মূল্যের ভিন্ন কোন উপাদান মিশ্রিত করিবার মাধ্যমে আপাতঃ ওজন বা পরিমাণ বৃদ্ধি বা আকর্ষণীয় করিয়া খাদ্যক্রেতার আর্থিক বা স্বাস্থ্যগত ক্ষতি সাধন করা হয়।" আইন অনুযায়ী ভেজাল খাদ্যের এই যে বিস্তর বর্ণনা তা কি দৃশ্যমান নয়?
অতি মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্মের কারণে বাজার সয়লাভ ভেজাল খাদ্যদ্রব্যে। ক্রেতা সাধারণের বোঝার উপায় নেই যে, কোনটা আসল আর কোনটা ভেজাল। ভেজাল খাদ্য খেয়ে মানুষ নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে দুর্বিসহ জীবনের সম্মূখীন হতে হচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ানক দিক হলো, শিশুখাদ্যে ভেজাল। শিশুরা আগামীর ভবিষ্যত। যারা হাল ধরবে আগামীর বাংলাদেশের। অথচ ভেজালযুক্ত খাদ্য খেয়ে শিশুরা রোগশোককে সাথী করে বেড়ে উঠছে। পঙ্গুত্ব বরণ করতে হচ্ছে। যা আগামীর জন্য অশনিসংকেত!
সারাদেশে খাদ্যদ্রব্যের ভয়ার্ত ভেজাল চিত্র দৃশ্যমান থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র কি যথাযথভাবে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে? সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহ কি মাঠপর্যায়ে প্রতিনিয়ত ভেজাল বিরোধী অভিযান কার্যকরীভাবে পরিচাললনা করছে? অসাধু ব্যবসায়ীরা যেহেতু বেপরোয়া তাই ভেজাল বিরোধী অভিযান প্রতিনিয়ত কঠোরভাবে পরিচালনা করা উচিত। এক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়ার কোন অবকাশ নেই।খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের সাথে জড়িত অসাধু ব্যবসায়ীরা পরোক্ষ হত্যাকারী। কারণ, ভেজাল খাবার খেয়ে মানুষ জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। এবং এ কারণে একসময় মৃত্যুরকোলে ঢলে পড়েন। তাই এদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
বাংলাদেশে খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে বিভিন্ন আইন রয়েছে। আইন সমূহে খাদ্যে ভেজালজনিত অপরাধে বিভিন্ন মাত্রার শাস্তির বিধান রয়েছে। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(গ) ধারার উপ-ধারা (১) এর (এ), (বি), (সি), (ডি) ও (ই)'তে বর্ণিত ভেজালজনিত অপরাধের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানাদন্ডের বিধান রয়েছে। এছাড়া, এই ধারার উপ-ধারা (২) এর (এ) ও (বি)'তে বর্ণিত ভেজালজনিত অপরাধের জন্য ০৫ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও জরিমানাদন্ডের বিধান রয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এর ৪১ ও ৪২ ধারায় খাদ্যে ভেজালজনিত অপরাধের জন্য অনূর্ধ্ব ০৩ বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক ০২ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিতকরণের বিধান রয়েছে। এছাড়া ২০১৩ সালে প্রণীত নিরাপদ খাদ্য আইনে ৭ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ভেজাল খাদ্যজনিত অপরাধের সাথে জড়িত অসাধু ব্যবসায়ীদের দমন করার লক্ষ্যে বর্ণিত আইনের ধারা সমূহ যথাযথভাবে প্রয়োগ করতেই হবে। এর কোন ব্যত্যয়ের সুযোগ নেই।
বাংলাদেশে ভেজাল খাদ্যপণ্যের যে উন্মুক্ত দস্যু চিত্র তার প্রেক্ষিতে বলা যায়, আমরা জেনেশুনে নিরুপায় হয়ে টাকা দিয়ে বিষ ক্রয় করে সে বিষ পান করছি। আলিঙ্গন করছি মৃত্যুকে। তবে সাধারণ মানুষ ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের থাবা থেকে মুক্তি চায়। সাধারণ মানুষের এই মুক্তি আকাঙ্খা বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে সক্রিয় কার্যকরী ভুমিকা পালন করতে হবে। খাদ্যে ভেজালজনিত অপরাধের সাথে যুক্ত অপরাধী চক্রকে দমন করতেই হবে।
লেখক পরিচিতি: সভাপতি, সমাজ রূপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘ, ময়মনসিংহ।
0 Comments